রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৪ অপরাহ্ন

দূরত্ব বাড়ছে ১৪ দলে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে হতে পারে নতুন সমীকরণ

দূরত্ব বাড়ছে ১৪ দলে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে হতে পারে নতুন সমীকরণ

স্বদেশ ডেস্ক:

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্ববাসী রাজনৈতিক দলগুলো ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর থেকে একটি প্লাটফর্মে আসার উদ্যোগ নেয়, যা ১৪ দলে স্থায়ী রূপ লাভ করে। পরে ওয়ান-ইলেভেনের পর সেই মোর্চা ঐক্যবদ্ধ প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারে আসে। একইভাবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জোটগতভাবে ১৪ দল ক্ষমতায় যায়। আওয়ামী লীগ লিডিং দল হলেও জোটের শরিকরা ২০০৮ সালের নির্বাচনে পর গঠিত সরকারের মন্ত্রিত্ব পায়। ২০১৪ সালেও মন্ত্রিসভায় স্থান পায় শরিকরা। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আর সেভাবে মন্ত্রিসভায় জায়গা করে নিতে পারেনি। দাবি অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রার্থিতা করতে পারেনি। এমন বাস্তবতায় গত তিন বছরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের শরিকদের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। ধীরে ধীরে তা রাজনৈতিক দূরত্ব লাভ করে বলে জোটের নেতাদের থেকে আভাস পাওয়া যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর গত এক বছর আগে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু জোটের মুখপাত্রের দায়িত্ব পান। আমির হোসেন আমুর দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পার হয়ে গেলেও জোটের শরিকদের মতামত নেওয়া কিংবা মতবিনিময় করার জন্য একটি সভাও হয়নি। মুখপাত্রের সঙ্গে এই সমন্বয়হীনতা, আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে মেলাতে না পারা এবং সর্বশেষ ১৫ আগস্ট জাতির জনক হত্যার সঙ্গে জাসদ (ইনু) জড়িত বলে দোষারোপের কারণে জোটে দূরত্বের দৌড়ে যেন আরও গতি পেল। এই অবস্থার উত্তরণের জন্য কোনো পক্ষ থেকে উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। এমতাবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে নতুন সমীকরণ হতে যাচ্ছে কিনা এমন সংশয় রয়েছে জোটে।

শরিকদের ভাষ্য, টানা তিনবারের ক্ষমতায় থাকা এবং তৃতীয় মেয়াদে শরিকদের কাউকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না দিয়েও আওয়ামী লীগ দেখেছে জোটে খুব একটা প্রতিক্রিয়া হয়নি। শক্তিশালী বিরোধী দল মাঠে না থাকায় বর্তমান রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ঠেকানো ছাড়া দলের তেমন কোনো চ্যালেঞ্জও নেই। এই বাস্তবতায় তাই শরিকদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে কিনা তা নিয়েও জোটে উঠেছে আলোচনার সুর। আছে ক্ষোভ, অভিমান ও শঙ্কা। এই পরিস্থিতিও জোটের কয়েকটি দলের মধ্যে আত্মতুষ্টি ছাড়া ভিন্ন বক্তব্য নেই। তারা দৃঢ়ভাবে বলছেন, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত সঠিক এবং এই সঠিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে তারা আছেন।

জানতে চাইলে বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমু আমাদের সময়কে বলেন, ‘বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে কারও সঙ্গে তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে না। সম্ভবও নয়। তিনি আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা নানা ইস্যুতে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান করেছি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। স্বাভাবিক হলে সবাইকে নিয়ে বসে আলোচনা করার ইচ্ছে আছে।’

দিবসভিত্তিক আলোচনা হতে পারলে জোটের ইস্যুতে কেন আলোচনা হতে পারবে না, এ নিয়েও জোটে আছে আলোচনা-সমালোচনা। এই প্রসঙ্গে জাসদ (আম্বিয়া)-এর সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া আমাদের সময়কে বলেন, ‘১৪ দল এখন অতীত। এখনকার রাজনীতি নতুনদের চাহিদা পূরণে। নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ফিরিয়ে আনা। সেই সঙ্গে ঘোষ, দুর্নীতি বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া। এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের আগ্রহ দেখছি না। ফলে এই জোট নিয়ে জাতির সামনে দেখানোর কিছু নেই। এখন নতুন এজেন্ডা নিয়ে ভাবতে হবে। অতীতে অনেক ভালো কাজ হয়েছে। ভবিষ্যতেও অনেক কাজ করার আছে।’

জাসদ (ইনু)-এর সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বক্তব্য ভিন্ন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘১৪ দল বাস্তবে আছে, থাকবে। প্যান্ডামিকের কারণে এর কার্যক্রমে ধীরগতি। তবে আওয়ামী লীগ নিজেই সক্রিয় না; এলোমেলো। সেই প্রভাব ১৪ দলে পড়েছে। কিন্তু এর লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন নেই। ১৪ দলের লক্ষ্যে আমরা এখনো পৌঁছতে পারিনি। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর দরকার আছে।’

জাসদ (ইনু)-এর সহসভাপতি শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় আসে। ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। পরবর্তীতে আবার মুক্তিযুদ্ধে বিপক্ষের সদস্য ক্ষমতায় আসে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় আনার জন্য ১৪ দল গঠিত হয়। এরপর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সফলতা আসতে শুরু করে। যতদূর পর্যন্ত সরকারি দলে এবং বিরোধী দলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি না আসবে ততদিন এই জোটের ঐক্য ধরে রাখতে হবে।’

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জাসুদ (ইনু)কে দায়ী করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম একাধিকবার বক্তব্য দেওয়ার পরও দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি, নীরব থেকেছে। এতে জাসদ ধরেই নিয়েছে এই বক্তব্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্মতি আছে। ফলে ১৪ দলে থাকার ইচ্ছা থাকলেও আগামী নির্বাচনের আগে জাসদকে বাদ দেবে কিনা এই শঙ্কাও আছে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না পাওয়া এবং নানাবিধ ইস্যুতে কথা বলার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জোটের নেতৃত্বদানকারী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সুদৃষ্টি না পাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও সাম্যবাদী দল। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জোটের বাইরে গিয়ে তাদের ভিন্ন কিছু ভাবতে হয় কিনা এই শঙ্কাও তাদের রয়েছে। এই বিষয়ে জানতে চেয়ে কল দিলে ওয়ার্কার্স পার্টি ও সাম্যবাদী দলের কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

এই বিষয়ে আমির হোসেন আমু বলেন, ‘আপাতত ১৪ দলীয় জোটের কলেবর বাড়ানোর মতো দল আমাদের সামনে নেই। জোট থেকে কাউকে বাদ দেওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না।’

জোটের অব্যাহত বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে আমলে না নিয়ে আত্মতুষ্টিতেই আছে তরিকত ফেডারেশন, গণআজাদী লীগসহ আরও কয়েকটি শরিক দল। তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘জোট নিয়ে আমি ভেরি মাচ হ্যাপি। প্যান্ডামিকের মধ্যে আর কী হতে পারে? এই পরিস্থিতিতেও আমার সঙ্গে জোটের মুখপাত্রের কথা হয়। আমি আমার বক্তব্য শেয়ার করি। আওয়ামী লীগ সভাপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিনি নিজে এই জোট করেছেন। এই জোট থাকবে। প্যান্ডামিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিশ্চিয়ই আমরা একসঙ্গে বসব। আমরা আমাদের কথা বলব, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব।’

গণআজাদী লীগের সভাপতি এসকে শিকদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমু করোনাকালীন পরিস্থিতিতে রেস্ট্রিকশনে আছেন। এতে জোটের কিছু কিছু লোকের অভিমান আছে। কিছু না পাওয়ার বেদনা আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু পাওয়ার জন্য রাজনীতি করি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্লোভ নীতি আমাকে স্পর্শ করেছে, তাই জোটে যুক্ত হয়েছি। সাম্প্রদায়িক শক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের এই আদর্শিক জোট। এই জোটের ভাবধারা বিলীন হওয়ার নয়।’

শরিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জোটের প্রথম থেকেই ২৩ দফা ঘোষণা দিয়ে ১৪ দলীয় জোটের যাত্রা শুরু হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও ১১ দলীয় জোট মিলে এই জোট গঠিত হয়। কিন্তু জোট গঠনের পরপরই ১১ দল থেকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)সহ কয়েকটি দল বেরিয়ে যায়। কিন্তু জোটটি ১৪ দল নামেই বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। পরে ২০০৭ সালের এক-এগারোর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় জোটের শরিক ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম।

দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে ১৪ দল ছেড়ে না গেলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ কয়েকটি দল নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার প্রায় ১৩ বছরে আর কোনো দল আওয়ামী লীগের জোট ছেড়ে যায়নি। বরং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) ও নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর নেতৃত্বাধীন তরিকত ফেডারেশন জোটে যোগ দেয়।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877